শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ০৫:২৬ পূর্বাহ্ন

এক বালকের মুক্তিযুদ্ধ

সাংবাদিকের নাম:
  • আপডেট সময় : সোমবার, ২০ মার্চ, ২০২৩
  • ৪৫১ জন দেখেছেন

এক বালকের মুক্তিযুদ্ধ

লেখক- মোঃ আবু তালহা

ফাল্গুন মাসের মাঝামাঝি সময়। দুপুরে রোদের মধ্যে রাস্তার পাশ দিয়ে হেঁটে যাচ্ছিল এক
বালক। হঠাৎ রাস্তা দিয়ে কয়েকটি জিপে করে মাথায় লোহার টুপি পরে একদল লোক চলে যায়।
বালকটির মনে প্রশড়ব জাগে এরা কারা? কী করে এরা? এদের মাথায় লোহার টুপি পড়ের কেন? নানা
প্রশড়ব জাগে বালকের মনে। ভাবতে ভাবতে বাড়ি চলে যায় বালক। বালকটির নাম ছিল নিরব। রাতে
মায়ের কাছে প্রশড়ব করে নিরব। মা, মানুষ লোহার টুপি পড়ে কেন? মা বলে, এমন প্রশড়ব করছিস কেন
খোকা। খোকা তখন বলে মা, আজ রাস্তা দিয়ে আসার সময় দেখলাম লোহার টুপি পড়ে একদল মানুষ
জিপে করে যাচ্ছিল। বল মা এরা কারা? এরা লোহার টুপি পড়েছে কেন? ছেলের কথার কোন জবাব
না দিয়ে মা বলে খোকা ‘খাবি চল’। খাবার ঘরে গিয়ে নিরব দেখতে পায় বাবা রেডিওতে কিছু শুনছে।
তখন নিরব বাবাবে বলে, বাবা কী শুনছো? বাবা বলে বঙ্গবন্ধুর ভাষণ শুনছি খোকা। বাবার উত্তর
শুনেই খোকা খেতে বসে যায়। হঠাৎ বাহিরে গুলির আওয়াজ শুনতে পায় তারা। নিরব কিছু বুঝে উঠার
আগে মা বাবা তাকে বলে উঠে খোকা চল পালাতে হবে। খোকাকে নিয়ে মা বাবা দৌড়ে পালাতে
থাকে। দৌড়ে গিয়ে তারা দাঁড়ায় নদীর ঘাটে। খোকাকে নৌকায় উঠিয়ে দিয়ে মা বাবা উঠতে যাবে
এমন সময় এলোপাথারি গুলি এসে লাগে মা ও বাবার বুকে। নদী ধারে মুখ থুবড়ে পড়ে যায় মা বাবা।
খোকা কিছু বুঝে উঠার আগে নৌকা ছেড়ে দেয় মাঝি। কিছুক্ষণ পর খোকা বুঝতে পারে তার মা বাবা
নৌকায় উঠে নি। নিরব মাঝিকে জিজ্ঞেস করে, রহিম কাকা মা বাবা কোথায়? নৌকায় উঠেনি কেন?
মাঝি বলে, তোর মা বাবা মিলিটারির গুলিতে মারা গেছে। মা বাবার মারা যাবার কথা শুনেই বালক
পাথর হয়ে গেল। এবং মনে মনে ভাবতে আমার মা বাবাকে যারা মেরেছে তাদেরকে আমি বাঁচতে
দিবনা। পরের দিন নিরব নৌকা থেকে নেমে যায়। নৌকা থেকে নেমে হাঁটতে থাকে আর চারিদিকে
দেখে পোড়া বাড়িঘর, দোকানপাট। তার এবার বুঝতে দেরি হলনা যে, লোহার টুপি পড়া মানুষ
গুলোই এ কাজগুলো করেছে। ওরাই তার মা বাবাকে মেরে ফেলেছে। এবার নিরবের মনে
প্রতিশোধের আগুন দাউ দাউ করে জ্বলে উঠে। যেভাবে হোক তাদের প্রতিহত করতেই হবে। এসব
ভাবতে ভাবতে সে হাঁতে থাকে। হাঁটতে হাঁটতে তার পেটে ক্ষুধা লেগে যায়। সামনে দেখে একটি
পেয়ারা গাছ। ক্ষুধা নিবারণ করতে বালকটি গাছ থেকে চার-পাঁচটি পেয়ারা পেরে খায় এবং পরে ক্ষুধা
লাগলে খাবার জন্য কিছু পেয়ারা পেরে সঙ্গে নেয়। আবারও হাঁটতে থাকে বালক নিরব। নদীর ধারে
গিয়ে পেয়ারা রেখে গোসল করে নেয় সে। নদীতে গোসলের সময় সে একটি বিষয় লক্ষ্য করে। দেখে
নদীতে একটি নৌকা আছে, কিন্তু তাতে মাঝি নেই। নিরব মনে মনে ভাবে এই নৌকা দিয়েই সে
মিলিটারির সাথে কৌশলে যুদ্ধ করবে। এই নৌকা দিয়েই মিলিটারিকে পাড় করার সময় এই নদীতেই
ডুবিয়ে মারবে। নিরব নদীতে নৌকা দিয়ে লোকজন পাড় করতে লাগল, আর অপেক্ষা করতে লাগল
মিলিটারিদের জন্য। কখন আসে ঐ হায়নার দল। তখনই ওদের ডুবিয়ে মারবে। একদিন দুপুর বেলায়
সাত আটজন মিলিটারি আসল ঐ ঘাটে নদীর ওপর পাড়ে যাবার জন্য। বালক নিরব মনে মনে ভাবতে
লাগল এই তো সুযোগ পেয়েছি, আজ ওদের ডুবিয়ে মারব। মিলিটারিরা তাকে ডাক দিল নদীর ঐ
পাড়ে পাড় করে দেওয়ার জন্য। নিরবও এগিয়ে আসল এবং তাদের আদর করে নৌকায় তুলল পাড়
করে দেওয়ার জন্য। যেই নৌকা মাঝ নদীতে পৌছায় তখনই নিরব নৌকাটি ডুবিয়ে দিয়ে সাঁতরে
নদীর পাড়ে চলে আসে। পাড়ে দাড়িয়ে দাড়িয়ে ওদের হাবুডবু খেয়ে মরে যাওয়ার দৃশ্য দেখতে থাকে
আর বলতে থাকে।

‘লোহার টুপি তোদের মগজ খেয়েছে,
লোহার টুপি তোদের ডুবিয়ে মারছে’’

ছেলেটি আবার হাঁটতে শুরু করে। হাঁটতে হাঁটতে একটি গ্রামে গিয়ে পৌঁছায় এবং সে গ্রামে থাকতে শুরু
করে। ক্ষুধা নিবারনের জন্য সে গাছের ফল ও নদীর পানি খেয়ে থাকে। এক রাতে তার অনেক জ্বর আসে।
সে জ্বরে কাপতে কাপতে গিয়ে এক দোকানে আশ্রয় নেয়। রাত পেরিয়ে দিন। ঐ দোকানের পাশ দিয়ে হেঁটে
যাচ্ছিল তিনজন মুক্তিযোদ্ধা। তাঁদের নাম ছিল জিহাদ, মোস্তাক, বজলুর। হঠাৎ জিহাদের চোখে পড়ল
একজন ছেলে অসুস্থ অবস্থায় কাতরাচ্ছে। সাথে সাথে সে তার সঙ্গিদের নিয়ে বালকটির কাছে যায় এবং
বালকটিকে নিয়ে তাদের ক্যাম্পে চলে আসে। ক্যাম্পে এনে বালকটিকে সুস্থ করে। তারপর তার সমস্যার
কথা শুনে। নিরব বলতে থাকে তার মা-বাবাকে মিলিটারী কীভাবে মেরে ফেলেছে। সে কীভাবে মিলিটারিকে
মেরেছে। নিরবের মিলিটারিকে মারার গল্প শুনে তাকে সাবাস দেয় মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার শামসুল এবং সে বলে
তুই যুদ্ধ করতে পারবি, তোর দ্বারা যুদ্ধ করা সম্ভব। কমান্ডার শামসুল তাকে বলে কীরে নিরব পারবিতো যুদ্ধ
করতে। নিরব সাহসের সাথে বলে হ্যাঁ পারবো। কমান্ডার বলে সাব্বাস। নে মুড়ি খা-বলে সবাই মুড়ি খেতে
শুরু করে।
পরদিন মুক্তিযোদ্ধাদের ক্যাম্পে খবর আসে, মিলিটারিরা তাদের ক্যাম্পের পাশে বাঙ্কার খনন করবে।
খবর পেয়ে কমান্ডার বলে নিরব তোর যুদ্ধ করার সময় এসেছে। এখন তোকে যুদ্ধ করতে হবে। কীভাবে যুদ্ধ
করবো শামসুল ভাই? বলে নিরব। কমান্ডার শামসুল বলে তোকে মাটি কাটার দলে যোগ দিতে হবে। কিন্তু
মাটি কাটার দলে যোগ দিয়ে কিভাবে যুদ্ধ করবো? বলে বালক নিরব। কমান্ডার বলে শোন নিরব তোকে
একটা মাইন দিবো। বাঙ্কার কাঁটা শেষ হলে বাঙ্কার দেখার ছলে ভিতরে গিয়ে মাইন পুতে রেখে আসবি
পারবিনা। নিরব বললো পারবো শামসুল ভাই । আর শোন তোর কাজ হয়ে গেলে নদীর ধারে চলে আসবি।
আমরা ঐখানে নৌকা নিয়ে থাকবো। ঠিক আছে ভাই-বললো নিরব। কমান্ডার রাতে রাতে মাইনের ব্যাবস্থা
করে রাখে। সকাল হলেই কাজে লাগানোর পালা। পরদিন নিরবের কাজে যাবার পালা। নিরবের কোমরে
গামছায় করে মাইন বেঁধে দিলেনর মুক্তিযোদ্ধা জিহাদ। বললেন সাবধানে যাস। নিরব বললো আচ্ছা। নিরব
গিয়ে দাড়ালো রাস্তায়। কখন মাটি কাঁটার দল আসে। তখনই তাদের সাথে যাবে। ভাবতে ভাবতে ফজল চাচা
তার মাটি কাটার দল নিয়ে ঐ রাস্তা দিয়ে আসছিল। নিরব তখন দৌড়ে গিয়ে ফজল চাচাকে বলল-চাচা
আমাকেও তোমাদের সাথে কাজে নাও না। ফজল চাচা বলল, তুই ছোট ছেলে কাজ করতে পারিস। নিরব
জিদ ধরে বসলো- চাচা কাজে নাও, আমি পারবো। চাচা নিরবের জিদ দেখে ফজল চাচা বললো চল আমার
সাথে, কিন্তু দুষ্টুমি করবি না। নিরব বললো আচ্ছা চাচা ঠিক আছে।
ফজল চাচা তারা দল বল নিয়ে গিয়ে বাঙ্কার খননের কাজ শুরু করে। মাঝে মাঝে দুইজন করে
মিলিটারি সদস্য এসে কাজ তদারকি করে যায়। দুপুর হলে ফজল চাচা তার দলবল নিয়ে একটু বিশ্রাম করে
নেয়। ১০ মিনিট বিশ্রাম করে আবার কাজ শুরু করে ফজল চাচা। বাঙ্কার খনন শেষ হলে নিরব ফজল চাচাকে
বলে চাচা আমি একটু বাঙ্কারের ভেতরটা দেখে আসি। ফজল চাচা বললেন যা তবে তাড়াতাড়ি আসিস। নিরব
বললো আচ্ছা। বাঙ্কারের ভিতরে গিয়ে নিরব মাইন গুলো সুন্দর করে পুতে দেয়। উপরে উঠে নিরব ফজল
চাচাকে সালাম করে দৌড় দেয় নদির দিকে। ওখানে গিয়ে দেখে শামসুল ভাই, জিহাদ ভাই ও বজলুর ভাই
নৌকা নিয়ে তার জন্য অপেক্ষা করছে। নিরব তাড়াতাড়ি নৌকায় উঠে পড়ে। শামসুল ভাই তাকে জিজ্ঞেস
করে, কীরে কাজ হয়েছে। নিরব বলে তুমি যেমন বলেছিলে তেমনই হয়েছে। সাব্বাস- বলে বজলুর ভাই।
তারা সবাই মিলে নৌকা আড়ালে নিয়ে অপেক্ষায় থাকে মাইন ফাঁটার। কিছুক্ষন পরর বিকট শব্দে মাইন
বিস্ফোরণ হয়। মাইনের শব্দ শুনে নিরব আনন্দে বলে উঠে জয় বাংলা। নিরবের আনন্দের আর সিমা রাইলো
নাই। হঠাৎ শামসুল ভাই দেখে নিরব নৌকার গলিতে শুয়ে বাংলাদেশে পতাকা উড়াচ্ছে।

সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যেমে শেয়ার করুন

এই ক্যাটাগরির অরো খবর
Raytahost Facebook Sharing Powered By : Raytahost.com