শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪, ০৫:০১ অপরাহ্ন

আমাদের দেশে ক্যান্সার চিকিৎসার আরও সুযোগ সৃষ্টি করতে হবে

এম মতিউর রহমান মামুন
  • আপডেট সময় : শুক্রবার, ৩ মার্চ, ২০২৩
  • ৬০৩ জন দেখেছেন

এম মতিউর রহমান মামুনঃ

 

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর পতিসর  এসে বুঝতে পেরেছিলেন  নিরন্ন, অসহায়, হতদরিদ্র  মানুষের   চিকিৎসার কোন ব্যাবস্থা নেই। স্রষ্টার  নিকট প্রার্থনা রোগমুক্তি  একমাত্র পথ। সেই চিন্তা থেকেই কবিগুরু পতিসরে  দাতব্য চিকিৎসালয়  প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। রবীন্দ্রনাথ জীবনের শেষ দিকে আক্রান্ত হয়েছিলেন প্রস্টেট ক্যান্সারে। তখন ক্যান্সারের চিকিৎসা অপ্রতুল’।

কথাগুলো  বলছিলেন বাংলা একাডেমির পদক প্রাপ্ত লেখক ও গবেষক,  জার্মানির কোলন বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. গোলাম আবু জাকারিয়া।  তিনি  কবির সেই কর্মের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে  অনাদৃত অবহেলিত  পতিসরে কবির নামে ‘ রবীন্দ্র ক্যান্সার সেন্টার এ্যান্ড রিসার্চ ইনস্টিটিউট’ করছেন’।  কাজও অনেক এগিয়ে নিয়েছেন খুব শ্রিগ্রহ আমরা কাজ শুরু করতে পারবো । উদ্দেশ্য পিছিয়ে পড়া গণমানুষকে ক্যান্সারের মত মরণ ব্যাধীর চিকিৎসা দেওয়া। বিশেষ করে গ্রামাঞ্চলের মানুষ চিকিৎসা সেবা প্রপ্তির ক্ষেত্রে এখনও অনেকটা বঞ্চিত বলা চলে। গ্রামাঞ্চলের  মেয়েরা বেষ্ট ক্যান্সার, জরায়ু ক্যান্সারের মত মরণ ব্যাধীতে আক্রান্ত হলেও মুখফুটে বলতে চায়না।  পতিসরে    এমন একটা প্রতিষ্ঠান করার পরিকল্পনার জন্য অধ্যাপক জাকারিয়া এবং তাঁর প্রতিষ্ঠিত ‘আলো ভুবন ট্রাষ্ট’ আজীবন সমাদৃত হবে।

বলে রাখা দরকার বাংলাদেশে প্রতি বছর ৩ লাখের মতো মানুষ ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়। এর মধ্যে প্রায় আড়াই লাখ মানুষ ভালো চিকিৎসার অভাবে মারা যায়। চিকিৎসার জন্য যেতে হচ্ছে দেশের বাইরে তাতে আমরা আর্থিক ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছি। বাংলাদেশে ক্যান্সার নিয়ে পড়ালিখার পথ সৃষ্টি পরিত্রানের একমাত্র  উপায় বলে মনে করেছেন এই ক্যান্সার বিজ্ঞানি। সুযোগ পেলে তিনি ক্যান্সার নিয়ে পড়াশোনার  বিষয়ে কাজ করবেন, এর জন্য দরকার সরকারী পৃষ্টপোষকতা ও দেশের বৃত্তশালিদের সহযোগিতা।

যাহোক দেশপ্রেম, মাটি ও মানুষের প্রতি শ্রদ্ধা ভালবাসা পৃথিবীর যে কোন স্থানে বসেও প্রিয় জন্মভূমির কাজ করা সম্ভব, রবীন্দ্রনুরাগী ক্যান্সার বিজ্ঞানি  প্রফসর ড. গোলাম আবু জাকারিয়া তার উধাহরণ।

ছোট বেলায় দাদা আমির আলী ডাকতেন ‘গোরা’ বলে। যিনি আহারে বিহারে, নিদ্রায় জাগরণে, মগ্ন তৈচন্যশীলতার মাঝে প্রবাসে থেকেও অনুভব করেন দেশ,জাতি, ভাষা, সাহিত্য, সংস্কৃতি, মাটি ও মানুষকে।

প্রফেসর গোলাম আবু জাকারিয়া

প্রফেসর গোলাম আবু জাকারিয়া ১৯৫৩ সালের ৩১ ডিসেম্বর নওগাঁ জেলার ইকরকুঁড়ি গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন।

স্বাধীনতার পর ১৯৭২ সালে শিক্ষাবৃত্তি নিয়ে  জার্মানির হালে-ভিইটেনবার্গ বিশ্ববিদ্যালয়ে পদার্থবিদ্যায় পড়ার সুযোগ পান   তিনি। ১৯৭৮ সালে স্নাতক এবং ১৯৮০ সালে জার্মানির গটিঙ্গেইন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে চিকিৎসা পদার্থবিদ্যায় স্নাতকোত্তর সম্পন্ন করেন। ১৯৮৬ সালে হাইডেলবার্গ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পিএইচডি অর্জন করেন  এবং কোলন বিশ্ববিদ্যালয়ে কর্মে যোগ দেন  এই গুণী শিক্ষাবিদ। দেশের মানুষের প্রতি প্রগাঢ় অনুরাগ ও জাতির প্রতি শ্রদ্ধাবোধ থেকে জার্মানিতে ১৯৯৬ সালে প্রতিষ্ঠা করেন বাংলাদেশ স্টাডি অ্যান্ড ডেভেলপিং সেন্টার এবং ১৯৯৯ সালে বাংলাদেশে গণবিশ্ববিদ্যালয়ে একমাত্র তিনিই চিকিৎসায় পদার্থবিদ্যা বিষয়ে পড়াশোনা  চালু করেন  এবং   তত্বাবধান করছেন তিনি নিজেই।

জার্মান ভাষায় চিকিৎসা পদার্থবিদ্যার ওপর  ১০০টিরও বেশি গবেষণা প্রবন্ধ প্রকাশ এই প্রখ্যাত ক্যান্সারবিদ। তিনি বিশ্বের বিভিন্ন ক্যান্সার বিশেষজ্ঞ এবং বিজ্ঞানীদের সাথে দলবদ্ধভাবে কাজ করছেন উদ্দেশ্য   বাংলাদেশের  ক্যান্স্যার চিকিৎসার প্রসার ঘটানো, সফলতা পাবেন   প্রত্যাশা আমাদেরও। আধ্যাপক  জাকারিয়া  বিজ্ঞানচর্চার বাহিরে সাহিত্য সাধনায় নিজকে  নিমগ্ন রেখেছেন,  বাংলা সাহিত্যর লেখক, কবিদের  জার্মানিদের কাছে তুলে ধরতে নিজ উদ্যোগ গড়ে তুলেছেন    ‘বাংলাদেশ অধ্যয়ন কেন্দ্র’ নামে সংগঠন।

জার্মান ভাষায়  অনেক বই প্রকাশ করেছেন, ১৯৯৯ সালে জার্মান ভাষায় জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের গান ও কবিতার ওপর ভিত্তি করে সম্পাদনা করেন ‘লাইফ অ্যান্ড ওয়ার্ক অব দ্য বেঙ্গলি পোয়েট কাজী নজরুল ইসলাম’, বাংলা ভাষায় সম্পাদনা করেন ২০০১ সালে ‘বিশ্বায়ন ও বাংলাদেশ’, ২০০৬ সালে বেগম রোকেয়ার ওপর জার্মান ভাষায় লেখেন ‘রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেন_ অ্যান্ড পোট্র্রেট অব অ্যা বেঙ্গলি ফিমেল হিউমিনিস্ট’, ২০১১ সালে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ওপর জার্মান ভাষায় রচনা করেন ‘রবীন্দ্রনাথ ট্যাগর : ওয়ান্ডারার বিটুইন ওয়ার্ল্ডস’ যা সারা বিশ্বে সমাদৃত। জার্মানিতে  জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু’কে নিয়ে উচ্চতর গবেষণার জন্য  আরও একটি গবেষণা গ্রন্থ  ‘ফাউন্ডিং ফাদার, সোশ্যাল রিফরমার এ্যান্ড ভিশোনরি’ প্রকাশ করেছেন। বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে লেখা গবেষণা গ্রন্থ’টির মোরক উন্মোচন করেছেন মান্যবর রাষ্ট্রদূত, জনাব মোঃ মোশাররফ হোসেন ভূঁইয়া, এনডিসি।

২০১১ সালের ৭ মে নওগাঁর পতিসরে রবীন্দ্র ভাস্কর্য উন্মোচন অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন অধ্যাপক জাকারিয়া, সাবেক এমপি ইসরাফিল আলম ও লেখক এম মতিউর রহমান মামুন। ছবি: এম মতিউর রহমান

 

২০২৩ সালে অমর একুশে বই মেলায় তাঁকে নিয়ে ‘আলো ভুবন ট্র্যাষ্ট’  ঢাকা এবং ঢাকার বাইরের বহু গুণী লেখকদের লেখার সমন্বয়ে  স্মৃতিচারণ মূলক গ্রন্থ ‘অনুরাগীদের স্মৃতি কথায় অধ্যাপক জাকারিয়া বাংলাদেশে মেডিকেল ফ্রিজিক্সের  পথিকৃৎ’ প্রকাশ করেছেন যা বাংলাদেশে ক্যান্সার গবেষণা অগ্রণী ভূমিকা রাখতে সহয়তা করবে।

সামাজিক দায়বদ্ধতা থেকে  গ্রামের হতদরিদ্র, অসহায় নিরক্ষর   মানুষের কথা বিবেচনা করে ১৯৯৯ সালে নওগাঁ ইকরকুঁড়িতে প্রতিষ্ঠা করেন ‘ইকরকুঁড়ি উচ্চ বিদ্যালয়’। ২০০৯ সালে প্রতিষ্ঠা করেন মা ও শিশু স্বাস্থ্যকেন্দ্র। সেখানে গর্ভবতী মা ও শিশু’রা পাচ্ছে  চিকিৎসা সেবা। তাঁর সঙ্গে আমার পরিচয় রবীন্দ্র গবেষণার মধ্যদিয়েই। পেশায় পদার্থবিজ্ঞানী  হলেও সাহিত্যের প্রতি  প্রগাঢ় অনুরাগী। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সাহিত্য নিয়ে উচ্চ গবেষণাও করেছেন তিনি। ২০১১ সালে পতিসরে  রবীন্দ্রনাথের ছিয়াত্তর  বছর বয়সের ঐতিহাসিক ভাস্কর্য নির্মানে অগ্রণী ভূমিকা রেখেছেন যা প্রসংশনীয়। ঐতিহাসিক বললাম এই কারনে  যে ১৯৩৭ সালের ২৭ জুলাই রবীন্দ্রনাথ নদীপথে পতিসরে আসেন । সেদিন অসুস্থ কবি হাজার হাজার প্রজাদের উদ্দেশে ভাষণ দেন।ছিয়াত্তর বছর বয়সে—মৃত্যুর চার বছর আগে পতিসর থেকে শেষ বিদায়ের ভাষণে কবি কেঁদেছিলেন, হাজার হাজার প্রজা কেঁদেছিলেন, নাগর বয়ে নিয়ে গেল অশ্রুসিক্ত তার প্রিয় যাত্রীকে। এরপর কবির আর কখনো পতিসর তথা বাংলদেশে আসার সৌভাগ্য হয়ে ওঠেনি। সে দিনের বেদনাময় স্মৃতি ধরে রাখতে ভাস্কর্যটি করা ।  ৯০ দশকে পতিসর রবীন্দ্র কাচারী বাড়ি রাষ্ট্রীয়ভাবে সংরক্ষণের বিষয়ে কাজ করেছেন এই পদার্থবিজ্ঞানী। তাঁর চাওয়া ছিল পতিসরে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় হোক। সুযোগ পেলে তিনি  শেষ জীবন পর্যন্ত মাটি ও মানুষের জন্য কাজ করে যাবেন।

লেখক- রবীন্দ্রস্মৃতি সংগ্রাহক ও গবেষক।

সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যেমে শেয়ার করুন

এই ক্যাটাগরির অরো খবর
Raytahost Facebook Sharing Powered By : Raytahost.com