যেভাবে শুরু: ২০০০ সালের বন্যার সময় মেহেরপুর সদর উপজেলার গোপালপুর গ্রাম ছেড়ে ভূমিহীনদের জন্য গড়া আমঝুপি ইউনিয়নের রঘুনাথপুর আশ্রয়ণে আশ্রয় নেন করিম। সেখানে অন্যের এক বিঘা জমি ইজারা নিয়ে তিনি চাষাবাদ শুরু করেন। একই সঙ্গে শ্রম বিক্রি করেও জীবিকা চালাতেন। ২০০৭ সাল পর্যন্ত করিম ২০ হাজার টাকা জমান। তাঁর ইচ্ছা ছিল, ওই টাকা দিয়ে আরও দুই বিঘা জমি ইজারা নেবেন। কিন্তু সে বছর সার ও বীজের তীব্র সংকট দেখা দেয়। তখন মেহেরপুর সদর উপজেলার কৃষি কার্যালয়ের ব্লক সুপারভাইজার আশরাফুল ইসলাম তাঁকে লালা (লাল) জাতের কেঁচো সংগ্রহ করে তা গোবরে চাষ করে জৈব সার তৈরির পরামর্শ দেন।
পরামর্শ মনে ধরে করিমের। শুরু হয় তাঁর কেঁচো খোঁজা। একই বছর অক্টোবরে তিনি ভারতের নদীয়া জেলার কৃষ্ণনগর থানার শান্তিপুরের বাসিন্দা প্রদীপের বাড়ি যান। সেখানে ২০ দিন থেকে তিনি কেঁচো চাষের ওপর প্রশিক্ষণ নেন। এ সময় এলাকায় ঘুরে তিনি দেখেন, অধিকাংশ বাড়িতে কেঁচো দিয়ে জৈব সার তৈরি করা হচ্ছে। এ সার ব্যবহারের গুণে আশাব্যঞ্জক ফল পাচ্ছেন পশ্চিমবঙ্গের কৃষকেরা।
প্রশিক্ষণ শেষে পাঁচ হাজার টাকায় ২০ হাজার কেঁচো কিনে দেশে ফেরেন করিম। কেঁচোর প্রজনন ও জৈব সার তৈরির জন্য তিনি ১২ হাজার টাকায় একটি গাভি কেনেন। শুরু হয় তাঁর গোবরে কেঁচো চাষ করে সার তৈরি। এসব কেঁচো দেখতে লাল। গোবর খেয়ে এগুলো যে মল ছাড়ে, এটিই জৈব সার। দেখতে চায়ের দানার মতো লালচে কালো। প্রথমে ইজারা নেওয়া জমিতে এ সার ব্যবহার করে কাঙ্ক্ষিত ফল পান করিম। তাঁর জমিতে বাড়তি ফলন দেখে আশপাশের চাষিরা এ ব্যাপারে উত্সাহী হন। তাঁরা এসে কেঁচো ও সারের জন্য ধরনা দেন করিমের কাছে। এতে তাঁর আয়ের পথ সুগম হয়।
সাফল্যের সিঁড়ি বেয়ে: নিজের গরু থাকায় কেঁচো চাষ ও সার উত্পাদনে করিমের কোনো ব্যয় নেই। শীতকাল ছাড়া সারা বছরই কেঁচোর বাচ্চা হয়। আর এগুলোর বংশবিস্তারও খুব দ্রুত ঘটে। এ কারণে মাত্র দুই বছরে করিমের ২০ হাজার কেঁচো পাঁচ লাখে পৌঁছে।
প্রতিটি কেঁচো তিন টাকা দরে তাঁর পাঁচ লাখ কেঁচোর দাম এখন ১৫ লাখ টাকা। এর মধ্যে এক লাখ কেঁচো তিনি তিন লাখ টাকায় বিক্রি করেছেন। সার বিক্রি করে পেয়েছেন প্রায় এক লাখ টাকা। এই টাকা দিয়ে তিনি পাঁচটি গরু কিনেছেন এবং চাষাবাদের জন্য ইজারা নিয়েছেন ২০ বিঘা জমি। স্ত্রী ও সন্তানেরা এসব কাজে তাঁকে সহযোগিতা করছে।
করিম বলেন, ‘যে গরুতে দুধ দেয়, তার লাথিও ভালো। তাই সারা দিন কেঁচো নাড়াচাড়া করতে খারাপ লাগে না। মনে হয় যেন টাকা নাড়াচাড়া করছি।’
উপকার পেলেন যাঁরা: করিমের জৈব সার ব্যবহারকারী আমঝুপি ইউনিয়নের চাষি আলামিন হোসেন, জাহিদুর ইসলাম, শাহজাহান আলী, কাওসার আলী ও আশরাফুল ইসলাম বলেন, তাঁরা এখন জমিতে রাসায়নিক সারের বদলে করিমের উত্পাদিত জৈব সার ব্যবহার করছেন। এতে তাঁদের উত্পাদন ব্যয় যেমন কমেছে, তেমনি জমির উর্বরতা শক্তি বেড়ে ফসলের পুষ্টিমানও বহু গুণ বেড়েছে।
আমঝুপি ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান বোরহান উদ্দিন বলেন, করিমের জৈব সার এ অঞ্চলের মাটি ও কৃষককে বাঁচিয়েছে।
মেহেরপুর সদর উপজেলা কৃষি সম্প্রসারণ কর্মকর্তা জাহিদুল আমিন বলেন, আদর্শ মাটিতে পাঁচ ভাগ জৈব উপাদান থাকে। কিন্তু মাত্রাতিরিক্ত রাসায়নিক সার ব্যবহারের ফলে মেহেরপুরের মাটিতে এখন জৈব উপাদান আছে মাত্র এক ভাগ। গোবরে চাষ করা করিমের কেঁচো-সারে জৈব উপাদান আছে ৩০ ভাগ। আবার এই সারে মাটির আরও ১০ ধরনের উপাদান থাকায় ফসল বাড়ার সঙ্গে এর পুষ্টিমানও বাড়ছে। এ সার ব্যবহারে মাটির উর্বরতা শক্তিও বাড়ছে বহু গুণ। তিনি আরও বলেন, আমঝুপি ইউপির সহায়তায় মেহেরপুর সদর উপজেলা কৃষি সম্প্র্রসারণ বিভাগ প্রতিটি ওয়ার্ডে করিমের মতো কেঁচো-সার উত্পাদনের ভাটি (বেড) তৈরির পরিকল্পনা নিয়েছে। দেশের কয়েক জেলায় আবর্জনা পচিয়ে কেঁচো-সার তৈরি করা হলেও একমাত্র করিম গোবরে কেঁচো চাষ করে উত্কৃষ্টমানের জৈব সার তৈরি করছেন, যা একটি অনুকরণীয় উদাহরণ।
তথ্যসূত্র: দৈনিক প্রথম